কলারোয়া সরকারি কলেজের গৌরবময় সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হবে আগামী ১৩ এপ্রিল ২০২৪ :: কলারোয়া সরকারি কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪।

কলারোয়া সরকারি কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাস


দক্ষিণবঙ্গের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির অবিসংবাদিত নেতা এবং বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি, আমাদের পরম শ্রদ্ধার এবং প্রাণপ্রিয় শিক্ষাগুরু ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শেখ আমানুল্লাহ স্যার (জন্ম: ৫ই জুলাই ১৯২৯খ্রি., মৃত্যু: ৩১ আগস্ট ২০১৩খ্রি.) এর আত্মজীবনীমূলক লেখা “একজন শিক্ষকের কথকতা” গ্রন্থ থেকে সংকলিত ও মুদ্রিত।

অনেকদিন থেকে অনুভূত হচ্ছিল এখানে একটি কলেজের অভাব। দক্ষিণে সাতক্ষীরা মহাকুমা সদর ও উত্তরে যশোর জেলা সদর ছাড়া কোন কলেজ ছিল না; না পশ্চিমে-না পূর্বে। দরিদ্র কৃষক-মজুরের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা লাভ ছিল এক দুঃস্বপ্ন।এমনকি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেনির সন্তানরাও উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে ছিল বঞ্চিত। দু’চারটে ছেলে যারা সাতক্ষীরা কলেজে ভর্তি হতো তাদের ডেলি প্যাসেঞ্জার হিসেবে বাসের হ্যান্ডেল ধরে ঝুলতে ঝুলতে সাতক্ষীরা যাওয়া-আসা করতে হতো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এই করুণ অবস্থা আমাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে। আমি আমার পাশে জড়ো হওয়া শিক্ষাকর্মীদের সাথে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প ব্যক্ত করি। কেউ কেউ অতি উৎসাহ প্রদর্শন করেন। আবার কেউ কেউ কাজটি দুঃসাধ্য বলেই উদ্যোগটি অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্খা বলে নিরুৎসাহিত করেন। তবু অল্প আলোচনায় কলেজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প বাস্তবায়নের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তদানীন্তন সাতক্ষীরার এস.ডি.ও. জনাব শফিউর রহমান সিএসপি কে তখনি টেলিফোন করে এ ব্যাপারে তাঁর সাহায্য সহযোগিতা কামনা করি। তিনি আশাতীত সাড়া দিয়ে একটা নির্দিষ্ট দিনে সমগ্র থানার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, ১২ চেয়ারম্যান ও ৭২ জন ইউ. পি. সদস্যকে এক সভায় আমন্ত্রণ জানাতে বলেন। তিনি সভায় সভাপতিত্ব করতে সম্মত হলেন। নির্দিষ্ট দিনে সভা হলো। সভায় উপস্থিত হলেন আমার সহপাঠী বন্ধু মোঃ আতিয়ার রহমান এবং থানার সকল বিভাগীয় কর্মকর্তাবৃন্দসহ প্রায় সব বিশিষ্ট ব্যক্তি। কলেজ করার জন্য অর্থাভাবের প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আমি এই সভায় আমার বক্তৃতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত পঙক্তিমালা আবৃত্তি করলাম-“আমার ভান্ডার আছে ভরে/তোমা সবাকার ঘরে ঘরে/তোমরা চাহিলে সবে/এ পাত্র অক্ষয় হবে/ভিক্ষা অন্নে বাঁচবো বসুধা।” এ সভায় দারুণ উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এস.ডি.ও. শফিউর রহমান সাহেব নগদ বিশ টাকা দিয়ে দানের খতিয়ান উদ্বোধন করেন। কলারোয়ার বিশিষ্ট আলেম, দক্ষিন বাংলার কৃতি সন্তান পীর মৌলানা ময়েজউদ্দীন হামিদী পাঁচশত টাকা দান করেন। আরও অনেকে সভায় টাকা দেন। ঐ সভায় এস.ডি.ও. শফিউর রহমান সাহেবকে সভাপতি ও আমাকে সম্পাদক করে ঊনপঞ্চাশ সদস্যের একটি অর্গানাইজিং কমিটি গঠিত হয়। পরদিন থেকে আমরা বিপুল বেগে কাজে নেমে পড়ি। এ দলে যাঁদের নাম আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় তাঁরা হলেন মরহুম কেরামত আলী সরদার, মৌঃ আব্দুল আজিজ, মৌঃ মনিরুদ্দিন আহমেদ, শেখ আবুল কাসেম, মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, বি.এম. নজরুল ইসলাম, মোঃ আজিজুল হক চৌধুরী ও মরহুম নূরুল হক। কলারোয়া হাইস্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের কাছে সাহায্য চেয়ে আমি একখানা লিফলেট প্রচার করি। সে আবেদনে সাড়া দিয়ে এই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র যাঁরা টাকা পাঠান তাঁদের মধ্যে বাঁকড়ার ডা. গোলাম সরওয়ার এম.বি.বি.এস. ও কলারোয়ার আসাদুজ্জামান এম.এ. প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। কলারোয়া গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার মত একই কৌশলে প্রথমে কলারোয়া হাইস্কুলে সকালের সেশনে কলেজের প্রাথমিক কাজ শুরু করা হয়। স্কুলের পশ্চিম দালানের একটি ঘরে একটি টেবিল চেয়ার দিয়ে মোঃ আব্দুল খালেক সাহেবকে বসিয়ে দিয়ে ছাত্র ভর্তির কাজ শুরু করা হয়। তাঁকে পূর্বেই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন পরেই কলারোয়া কলেজের (অধুনা সরকারি) বর্তমান অবস্থানে কিছু জমি কিনে কলেজ স্কুল থেকে স্থানান্তর করা হয়। মোটা মোটা জিউলী গাছের খুঁটির মাথায় গোলপাতার চাল তুলে, চাঁচের বেড়া দিয়ে ক্লাস শুরু করা হয়। এই কলেজের নিজস্ব ঘরের প্রথমে জিউলী গাছের প্রথম খুঁটি পোতেন মৌলানা ময়েজউদ্দীন হামিদী পীর সাহেব। সি.এন্ড.বি. এর পরিত্যক্ত ইটভাটার জমি মূল মালিকদের কাছ থেকে কিনে জমিগুলি সি.এন্ড.বি. এর কাছ থেকে অবমুক্ত করে কলেজের নামে রেকর্ড করার প্রচেষ্টা চলছিল। প্রথম যিনি নাম মাত্র মূল্যে জমি দেন তিনি ছিলেন সদর ইউনিয়ন গোপীনাথপুরের চেয়ারম্যান মরহুম মোঃ মাহাবুবর রহমান। ইতোমধ্যে কলেজের সরকারি স্বীকৃতির জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমির বৈধ দলিল দরকার হলো। পাশেই বি.এম. নজরুল ইসলামের অনেক জমি। তিনি তখন বলতে গেলে সদ্য পিতৃহারা তরুণ। তিনি এক বাক্যে তিন বিঘা জমি কলেজের নামে রেজিস্ট্রি করে দিলেন এবং সহজেই আমরা কলেজের সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম। পরে অবশ্য ঐ সমুদয় জমি রেজিস্ট্রি দলিলমূলে নজরুল সাহেবকে ফেরৎ দেওয়া হয়। তবু ঐ সময়ে তাঁর ঐ সাময়িক জমি দান কলেজের জন্য ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পরে ইট ভাটার সমগ্র জমি সি.এন্ড.বি. (বর্তমান রোডস্ এন্ড হাই ওয়েজ) এর কাছ থেকে অবমুক্ত করে কলেজের নিজস্ব সম্পদে পরিণত করাটা ছিল এক সুদীর্ঘ ক্লান্তিহীন সংগ্রামের ফসল। এ কাজে দীর্ঘদিন ধরে কখনো তদবির ও কখনো আইনী লড়াই যে কতখানি কষ্টের ও ধৈর্য্যরে তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানেন না। একাজে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা পেয়েছি আজিজুল হক চৌধুরীর কাছ থেকে। আজ প্রায় ২২ বিঘা জমির উপর কলেজের যে সুরম্য অট্টালিকা শোভা পাচ্ছে তা প্রতিষ্ঠার পেছনে আমার ও আমার সহকর্মীদের যে কত ঘাম ঝরেছে এবং কতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে তা আজকের প্রজন্ম ঠিক ধারণা করতে পারবে না। আজকে যত্রতত্র স্কুল গজাচ্ছে, এখানে সেখানে কলেজ গজিয়ে উঠছে। কিন্তু সেদিন এই সব প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টির পশ্চাতে ছিল অনেক লোকের ত্যাগের দীর্ঘ ইতিহাস। শেষ পর্যন্ত কলারোয়া কলেজ প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু তখন প্রশ্ন হলো একে লালন-পালন করে বাঁচিয়ে রাখা যায় কীভাবে? অর্থের প্রয়োজন। এই অর্থ সংগ্রহের কাজে প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের অবদান স্মরণীয়। আমরা ছাত্রদের হাতে বস্তা তুলে দিয়ে বারো ইউনিয়নে ভাগ করে পাঠালাম ধান, পাট ও নগদ অর্থ সংগ্রহের জন্য। থানাব্যাপী মানুষের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত সাড়া পেলাম। বহু ধান, পাট ও নগদ টাকা সংগৃহীত হলো। স্মরণ করছি কোন এক গ্রামের এক নিঃস্ব বৃদ্ধার কথা। তিনি ছাত্রদের কাছে কাঁদাকাটি করেছেন একটা সিকি (২৫ পয়সা) গ্রহণ করার জন্য। আমার প্রিয় ছাত্ররা সেই সিকিটা এনে আমার টেবিলে রেখে ঘটনাটা বিবৃত করলো। সিকিটা তুলে নিতে আমি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলাম। আজও তা মনে আছে। প্রতিটি সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠছিলাম। ইংরেজির প্রভাষক কোনমতেই পাওয়া গেলনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ফল প্রকাশের পূর্বে বিভাগীয় প্রধানের কাছে ধর্না দিয়ে বসে থেকেছি একটি ছাত্র দেওয়ার জন্য। সেভাবে সদ্য পাস করা ছেলে ধরেও নিয়ে এসেছি। কিন্তু যতদিন তা না পেয়েছি ১ম ও ২য় বর্ষে আমি নিজেই বিনা পারিশ্রমিকে ইংরেজি পড়িয়েছি। এতকাজের ফাঁকেও রাত্রিতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে সকালে ক্লাসে লেকচার দিয়েছি। এতকিছু করেও কলেজটা ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হলো। দীর্ঘদিন বেতন না পেয়ে শিক্ষকগণ কলেজে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার ঘোষণা দিলেন। সমালোচকদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ তীক্ষ্ণ শরের মত শরীরে বিদ্ধ হতে থাকলো। এ প্রসঙ্গে পরশ্রীকাতরতা সম্পর্কে একটা প্রচলিত গল্পের কথা মনে পড়ছে। একজন গরীব মূর্খ লোকের ছেলে উচ্চশিক্ষা লাভ করছে শুনে ঈর্ষান্বিত প্রতিবেশী ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন - পড়লে কী হবে ? ও ছেলে পাস করবে না। ছেলে পাস করলে তিনি বললেন, - ও ছেলে চাকরি পাবে না। ছেলে চাকরি পেলে তিনি বললেন -চাকরি পেলে কী হবে? বেতন পাবে না। বলা বাহুল্য সে ছেলে বেতন পেল এবং প্রতিবেশী ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। এক্ষেত্রেও কিছু সংখ্যক নিন্দুক ব্যক্তি বলতে লাগলেন,-বলিনি কলেজ হলে কী হবে? ও কলেজ টিকবে না। ছ'কোর কাজ নয় হরিণ ধরা। কিন্তু এই সব মন্তব্যে আমরা আরও অনুপ্রাণিত হলাম। কলেজ নামক এ গরীব ছেলেটির চাকরি পাওয়া ও বেতন পাওয়া নিশ্চিত করতে আমরা কজন জীবনপণ করে মাঠে নামলাম। আমাদের শ্লোগান ছিল দুইটি- (১) বাড়ির ভাত খেয়ে বি.এ. পাস করো (২) কলারোয়া থানার প্রতি ঘরে অন্ততঃ একজন গ্রাজুয়েট চাই। হয়তো তা আজো পূরণ হয়নি। তবে তা হওয়ার পথে দ্রুত এগুচ্ছে এ থানার শিক্ষাযাত্রা। আমরা কিছু সংখ্যক ব্যক্তি থানার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত দিনে রাতে প্রত্যেক বাড়িতে সশরীরে হাজির হয়ে প্রত্যক্ষভাবে ভিক্ষা চেয়েছি। স্বেচ্ছায় অথবা লজ্জায় সবাই বড় বড় অঙ্কের টাকা আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। একজন গৃহস্থ যখন রাত্রি তিন টায় তাঁর দরজার সামনে আমি এবং আমার সাথে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন তখন তিনি নির্দ্বিধায় ঘরের ভেতর থেকে বড় অঙ্কের টাকা এনে আমাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এই ভিক্ষুকের দলে আমার সাথে ছিলেন প্রিন্সিপাল আব্দুস সোবহান, মরহুম কেরামত আলী, মৌঃ আব্দুল আজীজ, বি.এম. নজরুর ইসলাম, মোঃ শাহাদাৎ হোসেন, শেখ আবুল কাসেম, মোঃ আজিজুল হক চৌধুরী, মোঃ মোসলেমউদ্দিন, মোঃ হোসেন আলী চেয়ারম্যান প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। দিনে এক গৃহস্থবাড়িতে, রাতে আর এক গ্রামের আর এক গৃহস্থবাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়েছি আর টাকা সংগ্রহ করেছি। আশাতীত অর্থাগম হয়েছে এই পদ্ধতিতে। শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হয়েছে। তাঁরা খুশি হয়েছেন। ইতোমধ্যে কলেজে শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষাদানে আন্তরিকতা বেড়েছে। হাতে হাতে ফলও পাওয়া গেছে। পদার্থ বিদ্যার অধ্যাপক নুরুল ইসলামের নামে এ ক্ষেত্রে উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। তিনি বাজারে আড্ডারত ছাত্রদেরও ধরে নিয়ে নিজ বাসায় পড়িয়েছেন ঘন্টার পর ঘন্টা বিনা পারিশ্রমিকে। নিবেদিত প্রাণ অধ্যক্ষ আব্দুস সোবহানের সার্বক্ষণিক তত্বাবধানে অন্যান্য শিক্ষকগণও প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন চূড়ান্ত পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য ফল লাভের আশায়। এই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় উপর্যুপরি বেশ কিছু ছাত্র বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান লাভ করতে থাকলো। ১৯৭৬ সালে সম্মিলিত মেধা তালিকায় নিত্য গোপাল চৌধুরী ৫ম, ১৯৭৮ সালে রুহুল কুদ্দুস ৯ম ও ১৯৭৯ সালে আয়ুব আলী তৃতীয় স্থান লাভ করে। এই পর্যায়ে দূর দূরান্ত থেকে ছাত্র এসে ভর্তি হতে থাকলো। কলেজের আর্থিক দারিদ্র্য বাষ্পের মত উড়ে গেল। স্বচ্ছন্দ গতিতে চলতে থাকলো কলেজ ডিগ্রি পর্যায় পর্যন্ত। কলেজের এই স্থিতি ও অভাবিত উন্নয়নের জন্য যাঁর অবদান অবিস্মরণীয় ও সর্বাধিক তিনি হলেন এই কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ জনাব মোঃ আব্দুস সোবহান। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, সার্বক্ষণিক মঙ্গল চিন্তা ও প্রশ্নাতীত নিবেদন ছাড়া এই কলেজ এমনভাবে বাঁচতো কি না সন্দেহ! এই কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ঝাউডাঙ্গার বিশিষ্ট বস্ত্রব্যবসায়ী মোঃ জামাল উদ্দিন সাহেবের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে নগদ অর্থ দিয়ে এবং ঝাউডাঙ্গা বাজারে অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যবসায়ীদের আর্থিক সাহায্য দানে উদ্বুদ্ধ করে কলেজটি প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। অনুরূপভাবে বাগাআঁচড়া বাজারে সিদ্দিক সাহেবের উদ্যোগে ঐ বাজারের ব্যবসায়ীগণ কলেজটি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন। ১৯৮৮ সালে এই কলেজ সরকারি হয়ে গেল। আমাদের প্রয়োজন ফুরালো। প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির একটি নিষ্ঠুর উক্তি ! এই কলেজে ডিগ্রির অনুমোদন নেওয়ার জন্য আমি ও প্রিন্সিপাল ধর্না দিয়ে বসে আছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর ওমর ফারুক সাহেবের দেখাই পাওয়া যায় না। অবশেষে দেখা করে আবেদনপত্র পেশ করে যখন আমাদের কলেজটি পরিদর্শনের প্রার্থনা জানালাম, তখন তিনি শ্লেষ মিশ্রিত ভাষায় বললেন, শুধু ডিগ্রি কেন, একেবারে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আবেদন করুন না! তাঁর সঙ্গে আর কথা বলার ইচ্ছা হয়নি। তবুও গরজ বড় বালাই! তাই এরপরও অনেক বিনীতভাবে আবারও আবেদন জানাতে হয়েছিল। সে সময় আমাদের কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব শফিউর রহমান, সিএসপি সাহেব ছিলেন রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনার। তিনি অন্য কারো কাছ থেকে জেনেছিলেন আমি বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট হাউসে অবস্থান করছি। তক্ষুনি তিনি গাড়ি পাঠিয়ে তাঁর বাসায় নিয়ে গেলেন। এক সঙ্গে খাওয়া দাওয়ার পর জানতে চাইলেন কী কাজে আমি রাজশাহী এসেছি। বিষয়টি তাঁকে বললাম। আরও বললাম কলেজ পরিদর্শক সাহেবের রূঢ় ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের কথা! তিনি তৎক্ষণাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে ওমর ফারুক সাহেবকে টেলিফোনে বললেন কলেজটির ডিগ্রি অনুমোদন পাওয়ার যৌক্তিকতা। বললেন কলেজটির সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার কথা। কলেজটি পরিদর্শন করার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বললেন, পরিদর্শনের পর যদি আপনার মনে হয় অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়, তাহলে দিবেন না। তাঁর এই আলাপ মন্ত্রের মত কাজ করলো। এই শফিউর রহমান সাহেবই স্বরাষ্ট্র সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণের পর নির্বাচন কমিশনের কমিশনার হিসেবে যোগ দেন এবং এখনও সেই পদে বহাল আছেন। এই শফিউর রহমান সাহেবই ডেপুটি সেক্রেটারি পদে থাকাকালীন ১৯৭৯ সালে এই কলেজ থেকে আয়ুব আলী নামক একজন ছাত্র সম্মিলিত মেধা তালিকায় ৩য় স্থান লাভ করার খবর সংবাদ পত্রে পড়ে আমাকে অভিনন্দনসূচক একখানা পত্র লেখেন। গভার্নিং বডির প্রথম সভাপতি হিসেবে অফিসে টাঙানোর জন্য তার একখানা ছবি চেয়ে চিঠি লিখলে তিনি তা দেননি। উত্তরে লিখেছিলেন কলেজে আমার কী এমন অবদান আছে? কলারোয়া কলেজে যদি কারো ছবি একান্তই টানাতে হয় তা হবে আপনার ছবি। তাই কারো ছবিই আর টানানো হয়নি। যাইহোক, শফিউর রহমান সাহেবের কথায় প্রফেসর ওমর ফারুক সাহেব অনেক নরম হয়ে গিয়েছিলেন। তার উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর বারি সাহেব এই কলেজে ডিগ্রি অনুমোদনের জন্য ওমর ফারুক সাহেবকে অনুরোধ করেন। তাঁর সঙ্গে সখ্য ছিল কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মৌঃ আব্দুল আজীজ সাহেবের। তিনি, আমি ও প্রিন্সিপাল আব্দুস সোবহান সাহেব অনুরোধটা করলাম। পরদিন কলেজ পরিদর্শকের অফিসে ওমর ফারুক সাহেবের সঙ্গে দেখা করে দেখলাম এক পরিবর্তিত মানুষকে। তিনি আমাকে দেখে বসতে বলেই বললেন, “আপনার কি সাহেব সারা দেশে নেটওয়ার্ক পাতা আছে? আপনার কলেজের জ্বালায় তো কান ঝালাপালা হবার যোগাড়।” যাইহোক, তিনি পরিদর্শনের দিন দিলেন। নির্ধারিত দিনে তিনি এলেন। অনেক বড় আয়োজন করা হয়েছিল তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। ইতোমধ্যে কলেজের ঘরবাড়ি ফার্নিচার, ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি যথেষ্ট সমৃদ্ধ করা হয়েছিল। কলেজের দীর্ঘ হল ঘরের মধ্যে সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে তাঁকে বর্ণাঢ্য মঞ্চে বসানো হলো। তাঁর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কোন ক্রুটিই রাখা হলো না। তবে আমার স্বাগত বক্তব্যে ভদ্র ও মার্জিত ভাষার আবরণে তাঁর শ্লেষাত্মক উক্তির উপযুক্ত জবাব দিতে ভুল করিনি। কলেজটি ডিগ্রি অনুমোদনের যোগ্য কিনা তা প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলাম। প্রিন্সিপাল সহ আরও অনেকে চমৎকার ভাষায় বক্তৃতা করলেন। প্রত্যুত্তরে ওমর ফারুক সাহেব দ্বার্থহীন ভাষায় স্বীকার করলেন কলেজটি সম্পর্কে তাঁর ভুল ধারণার অবসান হয়েছে। তিনি বলেন, উত্তর বঙ্গের বহু স্থানে চাঁচের বেড়া দিয়ে একচালা টিনের ঘরে ডিগ্রি খুলে বসা কলেজগুলির সঙ্গে এই উন্নত কলেজটিকে একই শ্রেণিভুক্ত করা তাঁর মারাত্মক ভুল হয়েছে। আমার নাম ধরেই তিনি বললেন, তাঁর সঙ্গে আচরণের জন্যও আমি দুঃখিত। তাঁর বক্তৃতায় কলেজটিতে ডিগ্রি কোর্স অনুমোদনের সুষ্পষ্ট ঘোষণাই তিনি দিয়ে ফেললেন।